০৮:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সিলেটে চলছে চুক্তিভিত্তিক বিয়ের হিড়িক

print news -

সিলেটে চলছে চুক্তিভিত্তিক বিয়ের হিড়িক। সিলেট -সুনামগঞ্জ এই দুই জেলার প্রায় প্রতিটি এলাকায় উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা ছেলে-মেয়েদের একটা বড় অংশ পাড়ি জমাচ্ছে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
এসব এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখন এস.এস.সি পাশ করার পর থেকেই ছেলে- মেয়েদের ইউরোপে পাঠানোর পরিকল্পনা শুরু করেন অভিভাবকগন। এরপর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর ফলাফলের অপেক্ষা না করেই সন্তানদের আইইএলটিএসের প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দেন। এর মধ্যে আবার অভিভাবকেরা পাত্র-পাত্রী খোঁজাও শুরু করেন।
বর্তমান সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ওয়ার্ক পার্মিট এবং ভ্রমণ ভিসা বন্ধ থাকার কারণে সিলেট-সুনামগঞ্জের তরুণ-তরুণীরা স্টুডেন্ট ভিসা এবং কেয়ার ভিসা নিয়ে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। যেহেতু লন্ডনের সাথে ঐতিহাসিকভাবে সিলেটের একটা সংযোগ আছে। তরুণ-তরুণীদের প্রথম লক্ষ্যই থাকে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে পাড়ি দেওয়া। এর পাশাপাশি ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, জার্মানি, ফিনল্যান্ড প্রভৃতি দেশে যাচ্ছেন তারা।
সাধারণত ছেলে – মেয়ে যে কোনো এক জনের নামে ভিসা হয়ে গেলে সঙ্গে স্বামী বা স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। েস ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বিয়ে হয় চুক্তিভিত্তিক। মেয়ে যদি আইএলটিএসে আশানুরূপ স্কোর করেন তাহলে ছেলের পরিবার প্রায় শতভাগ খরচ বহন করে। অপরদিকে ছেলে যদি আইএলটিএস পাশ করে তাহলে ৫০-৫০ খরচ ভাগাভাগির চুক্তিতে বিয়ে হয়ে থাকে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইউরোপে গমনেচ্ছুক তরুণ-তরুণীরা মূলত চুক্তিভিত্তিক বিয়ে করে ইউরোপ পাড়ি জমাচ্ছেন। তাদের প্রায় ৮০ ভাগই যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যাচ্ছেন। ফলে এসব বিয়ের নাম পড়েছে ‘লন্ডনি বিয়ে’। দীর্ঘদিন ধরে সিলেটিদের বিয়েতে যে আভিজাত্য সেটি ধরে রাখতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ করার রেওয়াজ ছিল। লন্ডনি বিয়ের কারণে সেই রেওয়াজ বন্ধ হওয়ার পথে। এখন দুই পরিবারের সম্মতিতে খুব ছোট আয়োজনে বিয়ে সম্পন্ন করে বিয়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা ভিসা প্রসেসিংয়ে খরচ হচ্ছে।
এসব ক্ষেত্রে দুই ধরণের বিয়ে হয়ে থাকে। একটা হচ্ছে দুই পরিবারের সম্মতিতে তরুণ-তরুণীরা বাস্তবিক বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। আরেকটা হচ্ছে চুক্তিভিত্তিক বা কাগজে বিয়ে। চুক্তিভিত্তিক বা কাগজে বিয়ের ক্ষেত্রে নামমাত্র একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ক্যামেরাবন্দি করা হয়। কিন্তু তা ওই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। তাদের মধ্যে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। সংশ্লিষ্ট দেশে পৌঁছানোর পরে বর-কনের মধ্যে কোনো ধরনের সংযোগ থাকে না।
সিলেটিদের লন্ডন প্রীতির কারণে তারা লন্ডনি হিসেবে পরিচিত। গত দুই প্রজন্ম ধরে সিলেটিদের একটি ঐতিহ্য ছিল। তাদের মধ্যে লন্ডনে বসবাসরতদের ছেলে বা মেয়েকে দেশে থাকা তার ভাই-বোনের ছেলেমেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে লন্ডন নিয়ে যেতেন। কিন্ত বর্তমানে তা হ্রাস পেয়েছে। গত ১০-১২ বছর ধরে তা কমতে থাকে। অন্যদিকে বিয়ে বা চুক্তিভিত্তিক বিয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই পরিবর্তন করোনাভাইরাসের পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্টুডেন্ট ভিসা সহজ হওয়ার পর ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। সঙ্গে স্বামী বা স্ত্রীকে স্পাউস ভিসায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকায় আগ্রহীর সংখ্যা বাড়ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রবাসী বলেন, ব্রিটিশ-বাংলাদেশীদের নিজ দেশে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার প্রচলন ছিল। কিন্ত তৃতীয় প্রজন্মের মধ্যে এই হার অনেক কমে এসেছে। পূর্বে, অভিভাবকরা দেশে বিয়ে করতে সন্তানদের অনেকটা বাধ্য করতেন। কিন্ত বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েকে বাধ্য করে বিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে গেছে।
তিনি মনে করেন, এক্ষেত্রে শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রযুক্তির বিকাশ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। প্রযুক্তির ফলে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সচেতনতা, নিজেদের পছন্দ-অপছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া, প্রয়োজনে আইনি সহযোগিতা নেওয়া সহজ হয়েছে। আবার লন্ডনে থাকা বসবাসরত প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের সঙ্গে দেশের যে সংযোগ ছিল তা কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের নেই। তৃতীয় প্রজন্ম পিতৃভূমিতে ঘুরতে যাওয়ার চেয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বা মধ্যপ্রাচ্যের ঝলমলে শহর দুবাইয়ে যেতে বেশি পছন্দ করে। এক্ষেত্রে জীবনবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বড় প্রতিবন্ধকতা কাজ করে। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে অভিভাবকরা অনেকটা উদাসীন। ফলে দেশে থাকা স্বজনদের সাথে তাদের দূরত্ব কেবল বাড়তে থাকে।
লন্ডন তথা যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমালেই যে আর্থিক স্বচ্ছলতা বা নিজের উন্নত জীবন মেলে বিষয়টা এমন নয়। সেখানে গিয়ে তাদেরকে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। ভাষাগত সমস্যা ছাড়া যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের ব্যয়বহুল জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলা খুব কঠিন হয়। তাছাড়া এসব দেশে বাসা ভাড়া পাওয়ার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়।
এ বিষয়ে নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে যুক্তরাজ্যে থাকা এক তরুণ বলেন, বিয়ে, ভিসা প্রসেসিং সবমিলিয়ে প্রায় ২৮ লাখ টাকা খরচ করে কেয়ার ভিসাতে লন্ডনে এসেছি। এখানে এসে প্রথম ১৫ দিন চাচার বাসায় ছিলাম। একটা ছোট গেস্ট রুমে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতাম। এরপর শেয়ারিংয়ে একটা বাসা খুঁজে পেলেও কোনো কাজ পাচ্ছি না। ফলে দেশ থেকে আরও টাকা আনতে হচ্ছে।
সিলেটের বাসিন্দা লিমা আক্তারকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর মা রিপা বেগম তার চাচার বাসায় পাঠিয়ে দেন। সিলেটের মিরা বাজার এলাকার বাসায় বসে কথা হয় লিমার সাথে। তিনি বলেন, আব্বা মারা যান, এরপর আম্মাই আমাদের সংসার চালান। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর আইইএলটিএসের পড়াশোনার জন্য চাচার বাসায় আসি। পরীক্ষায় আমার আইইএলটিএস স্কোর ৬ আসে। এখন ভিসা প্রসেসিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে ঠিক হয়। কেয়ার ভিসায় প্রায় ২৫ লাখ টাকার মতো খরচ আসবে, যা আমার শ্বশুর পক্ষ বহন করবে।
যুক্তরাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার বাসিন্দা রহমান । তিনি সেখানকার বড় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবীদ ও কমিউনিটি নেতা। দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে বসবাস করায় দেশ ছেড়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানো তরুণ-তরুণীদের নিয়ে তার মতামত জানতে চাওয়া হয়।
সম্প্রতি একটা পারিবারিক প্রয়োজনে তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে আসা দম্পতিদের দুই ভাগে ভাগ করতে হবে। একপক্ষ এখানে এসে কাজ পেয়ে যায়, এদের হয়তো-বা সচেতন আত্মীয়স্বজন সেখানে থাকে। পাশাপাশি নিজেরা খুব চালাক হয়। আবার কেউ কেউ দেশটিতে গিয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে। দেশটিতে গিয়ে এরা প্রথম যে সমস্যায় পড়ে তা হচ্ছে ইংরেজি না জানা। দ্বিতীয় যে সমস্যা মোকাবিলা করে তা হলো বাসা ভাড়া না পাওয়া। বাসা না পেলে আপনি কাজ পাবেন না কিংবা দেশটিতে বসবাসও করতে পারবেন না। এরপর আপনাকে কাজ খুঁজতে হবে এবং বর্তমানে কাজের খুব সংকট রয়েছে। এই কাজ করে সেখানকার টিউশন ফি মেটানো নিজেদের খরচ চালানোর পাশাপাশি দেশে টাকা পাঠানো এটা সত্যিই কঠিন।
উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি যে বাসাটি ভাড়া দিয়ে ৬ মাস আগে ১৭০০ পাউন্ড পেতাম এখন সেই বাসার ভাড়া গত সপ্তাহে একজন অফার করেছে ২৫০০ পাউন্ড। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে যে পরিমাণ মানুষ যুক্তরাজ্যে যাচ্ছে তাদের তুলনায় সেখানে বাসা খুব কম।
আবার যারা কেয়ার ভিসায় যায় তারা কিন্ত যে কাজ করে তা মূলত আমাদের দেশের আয়ার কাজ। অর্থাৎ ন্যাপকিন বদলানো থেকে শুরু করে এমন সব কাজ যা তাদের নিজেদের জন্য বিব্রতকর। এসব ভিসায় এসে অন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে বেকায়দায় আছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার লন্ডন থেকে পালিয়ে ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। দেশে থাকতে এই তরুণরা যেভাবে চিন্তা করে প্রবাস জীবন তার চেয়ে অনেক কঠিন বলেই মনে করেন মিজানুর রহমান হিরু।
তবে লন্ডনি বিয়েকে ইতিবাচকভাবে দেখেন, যারা উন্নত জীবনের আশায় লন্ডন বা ইউরোপে পাড়ি জমায় তারা কিন্তু বেশ সফল। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে বলেই কিন্তু তারা ২০-২৫ লাখ টাকা খরচ করে লন্ডন যেতে পারছে। আবার বিয়েতে অহেতুক খরচ না করে কেউ যদি দেশের বাইরে যেতে এই টাকা খরচ করে তাহলে তা তাদের ক্যারিয়ারের জন্য ইতিবাচক।
একই অভিমত সমাজকর্মী তাওহিদুল বলেন, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে সিলেট অঞ্চলের মানুষ যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন, বংশ পরম্পরায় সে ধারাবাহিকতা এখনো বহমান রয়েছে। এ জন্য সিলেটকে দ্বিতীয় লন্ডন বলে। সিলেটের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিদেশমুখীতা রয়েছে এটা মূলত পূর্বপুরুষদের ধারাবাহিকতারই ফল। এটাকে আমি ইতিবাচক হিসাবেই দেখি। কারণ উন্নত বিশ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে নিজ পরিবার, গ্রাম, গোষ্ঠীর বা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যায়।

ট্যাগঃ
জনপ্রিয় সংবাদ

মুক্তিযুদ্ধা সংগঠক আব্দুর রাজ্জাকের ইন্তেকাল।। বিশিষ্টজনের শোক প্রকাশ

সিলেটে চলছে চুক্তিভিত্তিক বিয়ের হিড়িক

প্রকাশিত হয়েছেঃ ০৬:৩৫:০৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৩
print news -

সিলেটে চলছে চুক্তিভিত্তিক বিয়ের হিড়িক। সিলেট -সুনামগঞ্জ এই দুই জেলার প্রায় প্রতিটি এলাকায় উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা ছেলে-মেয়েদের একটা বড় অংশ পাড়ি জমাচ্ছে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
এসব এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখন এস.এস.সি পাশ করার পর থেকেই ছেলে- মেয়েদের ইউরোপে পাঠানোর পরিকল্পনা শুরু করেন অভিভাবকগন। এরপর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর ফলাফলের অপেক্ষা না করেই সন্তানদের আইইএলটিএসের প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দেন। এর মধ্যে আবার অভিভাবকেরা পাত্র-পাত্রী খোঁজাও শুরু করেন।
বর্তমান সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ওয়ার্ক পার্মিট এবং ভ্রমণ ভিসা বন্ধ থাকার কারণে সিলেট-সুনামগঞ্জের তরুণ-তরুণীরা স্টুডেন্ট ভিসা এবং কেয়ার ভিসা নিয়ে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। যেহেতু লন্ডনের সাথে ঐতিহাসিকভাবে সিলেটের একটা সংযোগ আছে। তরুণ-তরুণীদের প্রথম লক্ষ্যই থাকে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে পাড়ি দেওয়া। এর পাশাপাশি ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, জার্মানি, ফিনল্যান্ড প্রভৃতি দেশে যাচ্ছেন তারা।
সাধারণত ছেলে – মেয়ে যে কোনো এক জনের নামে ভিসা হয়ে গেলে সঙ্গে স্বামী বা স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। েস ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বিয়ে হয় চুক্তিভিত্তিক। মেয়ে যদি আইএলটিএসে আশানুরূপ স্কোর করেন তাহলে ছেলের পরিবার প্রায় শতভাগ খরচ বহন করে। অপরদিকে ছেলে যদি আইএলটিএস পাশ করে তাহলে ৫০-৫০ খরচ ভাগাভাগির চুক্তিতে বিয়ে হয়ে থাকে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইউরোপে গমনেচ্ছুক তরুণ-তরুণীরা মূলত চুক্তিভিত্তিক বিয়ে করে ইউরোপ পাড়ি জমাচ্ছেন। তাদের প্রায় ৮০ ভাগই যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যাচ্ছেন। ফলে এসব বিয়ের নাম পড়েছে ‘লন্ডনি বিয়ে’। দীর্ঘদিন ধরে সিলেটিদের বিয়েতে যে আভিজাত্য সেটি ধরে রাখতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ করার রেওয়াজ ছিল। লন্ডনি বিয়ের কারণে সেই রেওয়াজ বন্ধ হওয়ার পথে। এখন দুই পরিবারের সম্মতিতে খুব ছোট আয়োজনে বিয়ে সম্পন্ন করে বিয়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা ভিসা প্রসেসিংয়ে খরচ হচ্ছে।
এসব ক্ষেত্রে দুই ধরণের বিয়ে হয়ে থাকে। একটা হচ্ছে দুই পরিবারের সম্মতিতে তরুণ-তরুণীরা বাস্তবিক বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। আরেকটা হচ্ছে চুক্তিভিত্তিক বা কাগজে বিয়ে। চুক্তিভিত্তিক বা কাগজে বিয়ের ক্ষেত্রে নামমাত্র একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ক্যামেরাবন্দি করা হয়। কিন্তু তা ওই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। তাদের মধ্যে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। সংশ্লিষ্ট দেশে পৌঁছানোর পরে বর-কনের মধ্যে কোনো ধরনের সংযোগ থাকে না।
সিলেটিদের লন্ডন প্রীতির কারণে তারা লন্ডনি হিসেবে পরিচিত। গত দুই প্রজন্ম ধরে সিলেটিদের একটি ঐতিহ্য ছিল। তাদের মধ্যে লন্ডনে বসবাসরতদের ছেলে বা মেয়েকে দেশে থাকা তার ভাই-বোনের ছেলেমেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে লন্ডন নিয়ে যেতেন। কিন্ত বর্তমানে তা হ্রাস পেয়েছে। গত ১০-১২ বছর ধরে তা কমতে থাকে। অন্যদিকে বিয়ে বা চুক্তিভিত্তিক বিয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই পরিবর্তন করোনাভাইরাসের পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্টুডেন্ট ভিসা সহজ হওয়ার পর ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। সঙ্গে স্বামী বা স্ত্রীকে স্পাউস ভিসায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকায় আগ্রহীর সংখ্যা বাড়ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রবাসী বলেন, ব্রিটিশ-বাংলাদেশীদের নিজ দেশে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার প্রচলন ছিল। কিন্ত তৃতীয় প্রজন্মের মধ্যে এই হার অনেক কমে এসেছে। পূর্বে, অভিভাবকরা দেশে বিয়ে করতে সন্তানদের অনেকটা বাধ্য করতেন। কিন্ত বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েকে বাধ্য করে বিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে গেছে।
তিনি মনে করেন, এক্ষেত্রে শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রযুক্তির বিকাশ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। প্রযুক্তির ফলে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সচেতনতা, নিজেদের পছন্দ-অপছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া, প্রয়োজনে আইনি সহযোগিতা নেওয়া সহজ হয়েছে। আবার লন্ডনে থাকা বসবাসরত প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের সঙ্গে দেশের যে সংযোগ ছিল তা কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের নেই। তৃতীয় প্রজন্ম পিতৃভূমিতে ঘুরতে যাওয়ার চেয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বা মধ্যপ্রাচ্যের ঝলমলে শহর দুবাইয়ে যেতে বেশি পছন্দ করে। এক্ষেত্রে জীবনবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বড় প্রতিবন্ধকতা কাজ করে। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে অভিভাবকরা অনেকটা উদাসীন। ফলে দেশে থাকা স্বজনদের সাথে তাদের দূরত্ব কেবল বাড়তে থাকে।
লন্ডন তথা যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমালেই যে আর্থিক স্বচ্ছলতা বা নিজের উন্নত জীবন মেলে বিষয়টা এমন নয়। সেখানে গিয়ে তাদেরকে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। ভাষাগত সমস্যা ছাড়া যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের ব্যয়বহুল জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলা খুব কঠিন হয়। তাছাড়া এসব দেশে বাসা ভাড়া পাওয়ার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়।
এ বিষয়ে নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে যুক্তরাজ্যে থাকা এক তরুণ বলেন, বিয়ে, ভিসা প্রসেসিং সবমিলিয়ে প্রায় ২৮ লাখ টাকা খরচ করে কেয়ার ভিসাতে লন্ডনে এসেছি। এখানে এসে প্রথম ১৫ দিন চাচার বাসায় ছিলাম। একটা ছোট গেস্ট রুমে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতাম। এরপর শেয়ারিংয়ে একটা বাসা খুঁজে পেলেও কোনো কাজ পাচ্ছি না। ফলে দেশ থেকে আরও টাকা আনতে হচ্ছে।
সিলেটের বাসিন্দা লিমা আক্তারকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর মা রিপা বেগম তার চাচার বাসায় পাঠিয়ে দেন। সিলেটের মিরা বাজার এলাকার বাসায় বসে কথা হয় লিমার সাথে। তিনি বলেন, আব্বা মারা যান, এরপর আম্মাই আমাদের সংসার চালান। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর আইইএলটিএসের পড়াশোনার জন্য চাচার বাসায় আসি। পরীক্ষায় আমার আইইএলটিএস স্কোর ৬ আসে। এখন ভিসা প্রসেসিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে ঠিক হয়। কেয়ার ভিসায় প্রায় ২৫ লাখ টাকার মতো খরচ আসবে, যা আমার শ্বশুর পক্ষ বহন করবে।
যুক্তরাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার বাসিন্দা রহমান । তিনি সেখানকার বড় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবীদ ও কমিউনিটি নেতা। দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে বসবাস করায় দেশ ছেড়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানো তরুণ-তরুণীদের নিয়ে তার মতামত জানতে চাওয়া হয়।
সম্প্রতি একটা পারিবারিক প্রয়োজনে তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে আসা দম্পতিদের দুই ভাগে ভাগ করতে হবে। একপক্ষ এখানে এসে কাজ পেয়ে যায়, এদের হয়তো-বা সচেতন আত্মীয়স্বজন সেখানে থাকে। পাশাপাশি নিজেরা খুব চালাক হয়। আবার কেউ কেউ দেশটিতে গিয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে। দেশটিতে গিয়ে এরা প্রথম যে সমস্যায় পড়ে তা হচ্ছে ইংরেজি না জানা। দ্বিতীয় যে সমস্যা মোকাবিলা করে তা হলো বাসা ভাড়া না পাওয়া। বাসা না পেলে আপনি কাজ পাবেন না কিংবা দেশটিতে বসবাসও করতে পারবেন না। এরপর আপনাকে কাজ খুঁজতে হবে এবং বর্তমানে কাজের খুব সংকট রয়েছে। এই কাজ করে সেখানকার টিউশন ফি মেটানো নিজেদের খরচ চালানোর পাশাপাশি দেশে টাকা পাঠানো এটা সত্যিই কঠিন।
উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি যে বাসাটি ভাড়া দিয়ে ৬ মাস আগে ১৭০০ পাউন্ড পেতাম এখন সেই বাসার ভাড়া গত সপ্তাহে একজন অফার করেছে ২৫০০ পাউন্ড। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে যে পরিমাণ মানুষ যুক্তরাজ্যে যাচ্ছে তাদের তুলনায় সেখানে বাসা খুব কম।
আবার যারা কেয়ার ভিসায় যায় তারা কিন্ত যে কাজ করে তা মূলত আমাদের দেশের আয়ার কাজ। অর্থাৎ ন্যাপকিন বদলানো থেকে শুরু করে এমন সব কাজ যা তাদের নিজেদের জন্য বিব্রতকর। এসব ভিসায় এসে অন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে বেকায়দায় আছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার লন্ডন থেকে পালিয়ে ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। দেশে থাকতে এই তরুণরা যেভাবে চিন্তা করে প্রবাস জীবন তার চেয়ে অনেক কঠিন বলেই মনে করেন মিজানুর রহমান হিরু।
তবে লন্ডনি বিয়েকে ইতিবাচকভাবে দেখেন, যারা উন্নত জীবনের আশায় লন্ডন বা ইউরোপে পাড়ি জমায় তারা কিন্তু বেশ সফল। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে বলেই কিন্তু তারা ২০-২৫ লাখ টাকা খরচ করে লন্ডন যেতে পারছে। আবার বিয়েতে অহেতুক খরচ না করে কেউ যদি দেশের বাইরে যেতে এই টাকা খরচ করে তাহলে তা তাদের ক্যারিয়ারের জন্য ইতিবাচক।
একই অভিমত সমাজকর্মী তাওহিদুল বলেন, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে সিলেট অঞ্চলের মানুষ যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন, বংশ পরম্পরায় সে ধারাবাহিকতা এখনো বহমান রয়েছে। এ জন্য সিলেটকে দ্বিতীয় লন্ডন বলে। সিলেটের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিদেশমুখীতা রয়েছে এটা মূলত পূর্বপুরুষদের ধারাবাহিকতারই ফল। এটাকে আমি ইতিবাচক হিসাবেই দেখি। কারণ উন্নত বিশ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে নিজ পরিবার, গ্রাম, গোষ্ঠীর বা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যায়।