১১:৫৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

টেঙ্গরি রাঢ় কুকিরা চলে গেছে : বিয়ানীবাজার খারাপ কি করে হয়?

print news -

শুদ্ধ মৃত্তিকায় গঠন বিয়ানীবাজার খারাপ কি করে হয়? এই মাটির আলো বাতাসের নির্যাসে বেড়েওঠা মানুষেরা কখনো খারাপ হতে পারে না। যুগ- যুগান্তরের অতলে হারিয়ে যাওয়া সময়- এখনো এই মাটির গর্ভের ভিতর থেকে আলোর বিচ্ছুরণ প্রস্ফুটিত করে। এখানে অন্যায় অসভ্যতার স্থান হতে পারে না। অসভ্য নিকৃষ্ট অপরাধ করতে দেয়া যায় না। এখানে অসভ্য অন্যায়কারী, অপরাধী, দুষ্ট লোকের অভয়াশ্রম কখনো ছিল না। হতেও পরেনা। ভবিষ্যতেও হতে দেয়া যাবে না। পুত-পবিত্র এই মৃত্তিকার কাছে- এই হোক বিয়ানীবাজার এর মানুষের আমৃত্যু অঙ্গীকার।

হযরত শাহজালালের সিলেট আগমনের আগে থেকে বর্তমান বিয়ানীবাজার অঞ্চলে সভ্য শান্তিপ্রিয় জ্ঞানী গুণী মানুষের বসবাস ছিল। জুলুমবাজ নির্যাতনকারী অত্যাচারী রাজা গৌর গোবিন্দ সিলেট থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস কারোরই অজানা নয়। পঞ্চখণ্ড তথা আজকের বিয়ানীবাজারে সভ্য মানুষের বসবাসের গোড়াপত্তনের আগে টেঙ্গরি রাঢ় কুকিদের বসবাস ছিলো। সভ্যদের সাথে অসভ্যরা টিকে থাকতে পারেনি। সময়ে ব্যবধানে এরা চলে গেলেও তাঁদের উত্তরসূরি এখানে রেখে গেছেন কিনা?

এই মাটির, এই মৃত্তিকার প্রায় দুই হাজার বছরের ইতিহাস আছে। পৃথিবীর অনেক দেশ জাতি মানুষের ও অঞ্চলের এত প্রাচীন আদি সমৃদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্য নেই। এই মাটির আলোকিত ইতিহাস ঐতিহ্য এখনও বহমান আছে। কেউ কোনদিন কখনো তার দুষ্ট স্বভাব চরিত্র দিয়ে এই মাটির উজ্জ্বল আঙ্গিনাকে কলুষিত করে টিকে থাকতে পারেনি। এক সময় এখানে বসবাস করা টেঙ্গরি রাঢ় নাগা কুকিরা বিলীন হয়ে গেছেন। আলোয় আলোকিত প্রদীপ জ্বালানো মানুষের কাছে টিকতে পারেননি। এই অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আলোকিত জ্ঞানী মানুষের হাত ধরেই প্রায় দুই হাজার বছর আগে বিয়ানীবাজার জনপদের উত্তোরণ ও বিকাশ ঘটেছে। অসভ্যদের ধৃষ্টতার আস্ফালন এখানে চলতে পারেনা। চলতে দেয়া যায়কিনা মানুষই তাঁর প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাখেন।

বিয়ানীবাজার এর মাটির গর্ভ থেকে মানবতাবাদ ও ন্যায়ের বিধান রচিত হয়েছে। এই জমিন অমানবিক অন্যায়ের সাথে জড়িত ডাকাত দস্যু অপরাধ ও অপরাধীদের তীর্থভূমি হতে পারেনা। এখানে গড়ে ওঠা সকল মানবিক মানবতা ও ন্যায়- ন্যায়্যতাকে রক্ষা করা বিবেকবান মানুষের কর্তব্য। অমানবিক অন্যায়, অপরাধের হিংস্র সমাজতো ছিলোনা, ভারতবর্ষের সারস্বতসমাজের গৌরব ছিলো পঞ্চখণ্ডের বিয়ানীবাজার। দুই হাজার বছর আগে থেকে ভারতবর্ষের সারস্বতসমাজের দৃষ্টিপ্রদীপ ছিলো এই অঞ্চল। মহিমান্বিত এই অঞ্চলের মাটি ও মানুষের মর্যাদা ইতিহাস ঐতিহ্য বিরল। সেই মর্যাদা মানবতা ও মনুষ্যত্বের অহংকারের জায়গায়, মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে, অসভ্য ইতর অপরাধীদের বিচরণ ভূমি হয়ে ওঠতে পারেনা। এই জনপদের পবিত্র মাটি কলুষিত হলে, ইতিহাস ঐতিহ্য কলঙ্কিত হয়। ভারতীয় ন্যায় দর্শনের জনক রঘুনাথ শিরোমনির জন্মমাটির আঙ্গিনার ন্যায় নীতির বাগানে অসভ্যদের তাণ্ডব চলতে দেয়া যায়না।

মানবতাবাদের কিংবদন্তি, আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব, আজীবন মানবতার পূজারী, দেশ জাতির জন্য জীবন উৎসর্গকরা শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. জিসি দেবের উঠানে অপরাধীদের তাণ্ডবলীলা আর কতো চলবে। শুদ্ধ মৃত্তিকার উঠানে মানবতাবাদ ও ন্যায় নৈতিকতার যে ফুল ফুটে। এই ফুল বাগানে অপরাধীদের ঠাঁই হতে পারেনা। এই অঙ্গিনার ফুল বাগান রক্ষার দায়িত্ব একা মালীর ওপর বর্তায় না। পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যের পূজারী, সাম্য শান্তি সম্প্রীতি পূজারী, ন্যায় নীতি নৈতিকতার পূজারীদের ওপরও বর্তায়। বিবেকের মনুষ্যত্ব দিয়ে, অমনুষ্যত্ব হিংস্র জানোয়ারদের নির্মূলে গর্জে ওঠার এখন সময়। মানবের বসত বাড়িতে দানবদের হানা রুখতে হবে। সকল অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে, বিবেকের মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করুন। বিবেক বিসর্জন দিয়ে হাত গুটিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখা কাপুরুষ মুনাফিকের লক্ষণ হয়কিনা?

মানুষরূপী হিংস্র অপরাধীরা আমাদের চারপাশে ঘুরা ফেরা করছে। আমাদের গা ঘেঁষে চলাফেরা করছে। আমরা তাঁদের চিনতে পারিনা। চিনতে পারিনা বলেই তাঁরা একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি অমাদের সমাজে মানুষের জানমাল ও মর্যাদার মূল্য কমিয়ে দিয়েছে। সমাজে যখন অপরাধীদের লাগাম থাকেনা। অপরাধীরা অপরাধ করে যখন আইনের আওতায় আসেনা। একের পর এক অপরাধ করে পার পেয়ে যায়। পুলিশের উপস্থিতিতে অপরাধীরা যখন প্রকাশ্যে অস্ত্রহাতে মহড়া দিয়ে, ফৌজদারি কার্যবিধির লঙ্গন করে। তখন বুঝতে হবে অপরাধীরা বেপরোয়া। সমাজ অশান্তির দিকে নৈরাজ্যের পথে হাটছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। বিয়ানীবাজারের আইন শৃঙ্খলা খারাপ না ভালো। মানুষই ভালো জানেন। কতোটা খারাপ হলে, চিনির ট্রাক হাইজ্যাক হতে পারে।

বিয়ানীবাজারের চারখাই থেকে ২৪ লাখ টাকার চিনি ছিনতাই এর ঘটনায় জড়িত এরা কারা? এরা এই মাটির গর্ভের নির্যাস থেকে জন্ম নিয়েছেন কিনা? সঙ্গত কারণে গত কয়েকদিন থেকে, দেশ বিদেশের অনেক মানুষের মুখোমুখে এই প্রশ্নটি উড়ে বেড়াচ্ছে। যে বা যারাই হোক না কেন, আমাদের ঐতিহ্যের অহংকারের বাগান কোন পশু ধ্বংস করে দিতে পারেনা। মানুষ হিসাবে, মনুষ্যত্ব জীবনধারণ যারা করেন, তারা অপরাধীদের কখনো সমর্থন করেননা।

রাজনীতির ছত্রছায়ায় আমাদের গায়ে গায়ে থেকে মিলেমিশে যাওয়া চিনি সিন্ডিকেট সাথে জড়িতদের অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে। এদের বাড়িঘর বংশ পরিচয়সহ তিন পুরুষের আদিঅন্ত জনসম্মুখে প্রকাশের এখন সময়। অসভ্য দুষ্কৃতিকারী ডাকাত দলের চুরি, ডাকাতি হাইজ্যাক রাহাজানি দস্যুতার কারণে, আজ গোটা সমাজ উদ্বিগ্ন। উৎকণ্ঠায় আছেন প্রবাসীরা। এদের অসৎ, অপরাধ তৎপরতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায়না। এরা সুযোগ পেলেই লুটে নিবে। শুধু শুধু পুলিশ প্রশাসনের দিকে চেয়ে থাকলে হবে না। সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এদের সকল অন্যায় আইন বিরোধী অপকর্ম রুখে দিতে হবে।

বিয়ানীবাজারের মত একটি ঐতিহ্যবাহী এলাকায় চিনি বুঝাই ট্রাক ছিনতাই এর ঘটনাকে উপজেলার মানুষ সহজে মেনে নিতে পারছেন না। চিনি ছিনতাইয়ের নির্দেশদাতা ও গডফাদার সিলেট জেলা ছাত্রলীগের যেই হোকনা কেনো? তাঁকে গ্রেফতারের দাবী জানাতে বিয়ানীবাজারের জনগণের আপত্তি নেই। এদের দৌরাত্মের টুঠি এখনই চেপে ধরতে হবে। নতুবা এই গডফাদারের নির্দেশে বিয়ানীবাজার উপজেলার মানুষের বাসা বাড়িতে দিনে দুপুরে, যখন তখন চুরি- ডাকাতি রাহাজানী ছিনতাই এর ঘটনা বৃদ্ধি পাবে কিনা । এতে করে উপজেলা সামগ্রীক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে কিনা? চিনি ডাকাত হাইজ্যাকার অসভ্যদের গডফাদার, মদদদাতা, পৃষ্ঠপোষক ছাত্রলীগের ক্ষমতাধর কতিপয় অসৎ অসভ্য নেতাদের সাহস হয় কি করে? বিয়ানীবাজার জনপদের ভিতরে তাদের অসৎ দুষ্কর্ম করার। তাদেরকে কে সাহস ও সুযোগ দিয়েছে। এরা বিয়ানীবাজারের স্থানীয় না বহিরাগত? নাকি টেঙ্গরি রাঢ় কুকিদের কোন উত্তরসূরী?

বিয়ানীবাজার উপজেলায়, আমার মতো অনেকের বাড়ি, অনেকের বাড়ির উঠান। আমার মতো আপনাদের বাড়ির আঙ্গিনায় জেলার চিনি ডাকাতরা রাষ্ট্রের আইন লঙ্ঘন করার যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। এতে আমাদের ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কিনা? উপজেলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হওয়ার পরও হাতেগোনা মানুষরূপী দস্যু দানব ডাকাতের কাছে পরাজিত হওয়ার গ্লানি রাখবেন কোথায়? প্রতিবেশী জেলা উপজেলার মানুষ কি বলতেছে কানপেতে শুনুন। সিলেটে বসে ছাত্রলীগ নামধারী যে সকল চিনি-ডাকাত হাইজ্যাকা তাদের দলীয় অনুগত্য বাহিনীর দ্বারা বিয়ানীবাজার এলাকায় ডাকাতি চুরি হাইজ্যাক ছিনতাই রাহাজানির রামরাজত্ব কায়েম করার দিবাস্বপ্ন দেখছেন। মানুষ হিসাবে, কোনো মানুষ বেঁচে থাকতে, ওই অসৎ স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবেনা। এটা শুদ্ধ মৃত্তিকার জনপদ বিয়ানীবাজার। এই মৃত্তিকার মাটি যেমন কোমল নরম। সময়ের প্রয়োজনে এই মাটি, কঠিন শিলায় রূপান্তরিত হয়ে আঘাত করতে জানে। রাজপথে জনতার আল্টিমেটাম সময়ের ব্যাপারমাত্র। জেলা- উপজেলার লুঠেরা ডাকাতদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসতে প্রশাসনের সময় ক্ষেপণ মানুষ বরদাস্ত করবেনা। জেলা ও থানা পুলিশের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন অজস্র মানুষ।

আমাদের বিয়ানীবাজার উপজেলার সকল মানুষের জান মাল ইজ্জত মর্যাদা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব শুধুমাত্র পুলিশ প্রশাসনের নয়। পুলিশের ওসি বা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এই অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নজরদারি করবেন। এর পাশাপাশি আইন প্রয়োগের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর হবেন। আইনশৃঙ্খলার অবনতি পুলিশের ব্যর্থতার বিষয়টি আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আইনশৃঙ্খলা কমিটি ও উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় কমিটির সভায় সংশ্লিষ্টদের কাছে কৈফিয়ত চাইবেন। জবাবদিহিতা করবেন। সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি কাছ থেকে মানুষ এমনটাই প্রত্যাশা করে। মানুষের ভাষায় মানুষের মনের কথা বলাই জনপ্রতিনিধির কাজ ও কর্তব্য। অপরাধীদের পক্ষে তাঁবেদারি করে সাফাই গাওয়া দায়িত্বশীলদের কাজ নয় মনে রাখতে হবে।

আমার মতো অনেকেরই প্রশ্ন হচ্ছে? উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানা পুলিশের ভাবপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আপনাদের বাড়ীর আঙ্গিনায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে গেলো। আপনাদের ভূমিকা মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয় কেন? আপনাদের পেশাদারিত্ব জবাবদিহিতার জায়গা দুর্বল হলে অসভ্য ডাকাত লুঠেরা দস্যুরা সুযোগ নিবে। আইনের রক্ষক হিসেবে পুলিশের কাজ নয় অপরাধীদের সাথে সমঝোতা করা। চিনি ডাকাতি কাণ্ডে দুই ছাত্রলীগ নেতার অডিও কথোপকথনে পুলিশের ভূমিকা ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লবের ভূমিকা তাঁদের ব্যক্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধে করেছে কিনা। তাঁরাই জানেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে থেকে বলতে হয়, নিজেদের নিয়ন্ত্রিত, পালাপোষা ডাকাতরা অনেক সময়, অনেক ওসি, এমপি, সরকারি কর্মকর্তা, চেয়ারম্যানদের বাসা বাড়িতে সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে। দুষ্কৃতিকারী দস্যু চিনি ডাকাত ও তাদের সহযোগীদের অবিলম্বে আইনের আওতায় নিয়ে আসা আপনাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কিনা? ডাকাত অপরাধী, সে যেই হোক, তার ক্ষমতার হাত যতই লম্বা হোক। সে মন্ত্রী-এমপি বা কোন বিশেষ ব্যক্তির লোক হোক। তাতে কি? সে তো রাষ্ট্র সমাজ ও আইনের চোখে অপরাধী। অপরাধী হিসেবে সমাজের কাছে পরিচিত। এই অপরাধীকে আইনের আনতেই হবে। বিয়ানীবাজারের মানুষ চায়, প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিজেদের অর্জিত অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব দিয়ে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন। উপজেলার মানুষের সামগ্রিক জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন।

লেখক : সাংবাদিক ও সমাজ অনুশীলক

ট্যাগঃ
জনপ্রিয় সংবাদ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক-হাসনাত আবদুল্লাহ

টেঙ্গরি রাঢ় কুকিরা চলে গেছে : বিয়ানীবাজার খারাপ কি করে হয়?

প্রকাশিত হয়েছেঃ ০৫:৪৭:২৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ জুন ২০২৪
print news -

শুদ্ধ মৃত্তিকায় গঠন বিয়ানীবাজার খারাপ কি করে হয়? এই মাটির আলো বাতাসের নির্যাসে বেড়েওঠা মানুষেরা কখনো খারাপ হতে পারে না। যুগ- যুগান্তরের অতলে হারিয়ে যাওয়া সময়- এখনো এই মাটির গর্ভের ভিতর থেকে আলোর বিচ্ছুরণ প্রস্ফুটিত করে। এখানে অন্যায় অসভ্যতার স্থান হতে পারে না। অসভ্য নিকৃষ্ট অপরাধ করতে দেয়া যায় না। এখানে অসভ্য অন্যায়কারী, অপরাধী, দুষ্ট লোকের অভয়াশ্রম কখনো ছিল না। হতেও পরেনা। ভবিষ্যতেও হতে দেয়া যাবে না। পুত-পবিত্র এই মৃত্তিকার কাছে- এই হোক বিয়ানীবাজার এর মানুষের আমৃত্যু অঙ্গীকার।

হযরত শাহজালালের সিলেট আগমনের আগে থেকে বর্তমান বিয়ানীবাজার অঞ্চলে সভ্য শান্তিপ্রিয় জ্ঞানী গুণী মানুষের বসবাস ছিল। জুলুমবাজ নির্যাতনকারী অত্যাচারী রাজা গৌর গোবিন্দ সিলেট থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস কারোরই অজানা নয়। পঞ্চখণ্ড তথা আজকের বিয়ানীবাজারে সভ্য মানুষের বসবাসের গোড়াপত্তনের আগে টেঙ্গরি রাঢ় কুকিদের বসবাস ছিলো। সভ্যদের সাথে অসভ্যরা টিকে থাকতে পারেনি। সময়ে ব্যবধানে এরা চলে গেলেও তাঁদের উত্তরসূরি এখানে রেখে গেছেন কিনা?

এই মাটির, এই মৃত্তিকার প্রায় দুই হাজার বছরের ইতিহাস আছে। পৃথিবীর অনেক দেশ জাতি মানুষের ও অঞ্চলের এত প্রাচীন আদি সমৃদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্য নেই। এই মাটির আলোকিত ইতিহাস ঐতিহ্য এখনও বহমান আছে। কেউ কোনদিন কখনো তার দুষ্ট স্বভাব চরিত্র দিয়ে এই মাটির উজ্জ্বল আঙ্গিনাকে কলুষিত করে টিকে থাকতে পারেনি। এক সময় এখানে বসবাস করা টেঙ্গরি রাঢ় নাগা কুকিরা বিলীন হয়ে গেছেন। আলোয় আলোকিত প্রদীপ জ্বালানো মানুষের কাছে টিকতে পারেননি। এই অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আলোকিত জ্ঞানী মানুষের হাত ধরেই প্রায় দুই হাজার বছর আগে বিয়ানীবাজার জনপদের উত্তোরণ ও বিকাশ ঘটেছে। অসভ্যদের ধৃষ্টতার আস্ফালন এখানে চলতে পারেনা। চলতে দেয়া যায়কিনা মানুষই তাঁর প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাখেন।

বিয়ানীবাজার এর মাটির গর্ভ থেকে মানবতাবাদ ও ন্যায়ের বিধান রচিত হয়েছে। এই জমিন অমানবিক অন্যায়ের সাথে জড়িত ডাকাত দস্যু অপরাধ ও অপরাধীদের তীর্থভূমি হতে পারেনা। এখানে গড়ে ওঠা সকল মানবিক মানবতা ও ন্যায়- ন্যায়্যতাকে রক্ষা করা বিবেকবান মানুষের কর্তব্য। অমানবিক অন্যায়, অপরাধের হিংস্র সমাজতো ছিলোনা, ভারতবর্ষের সারস্বতসমাজের গৌরব ছিলো পঞ্চখণ্ডের বিয়ানীবাজার। দুই হাজার বছর আগে থেকে ভারতবর্ষের সারস্বতসমাজের দৃষ্টিপ্রদীপ ছিলো এই অঞ্চল। মহিমান্বিত এই অঞ্চলের মাটি ও মানুষের মর্যাদা ইতিহাস ঐতিহ্য বিরল। সেই মর্যাদা মানবতা ও মনুষ্যত্বের অহংকারের জায়গায়, মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে, অসভ্য ইতর অপরাধীদের বিচরণ ভূমি হয়ে ওঠতে পারেনা। এই জনপদের পবিত্র মাটি কলুষিত হলে, ইতিহাস ঐতিহ্য কলঙ্কিত হয়। ভারতীয় ন্যায় দর্শনের জনক রঘুনাথ শিরোমনির জন্মমাটির আঙ্গিনার ন্যায় নীতির বাগানে অসভ্যদের তাণ্ডব চলতে দেয়া যায়না।

মানবতাবাদের কিংবদন্তি, আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব, আজীবন মানবতার পূজারী, দেশ জাতির জন্য জীবন উৎসর্গকরা শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. জিসি দেবের উঠানে অপরাধীদের তাণ্ডবলীলা আর কতো চলবে। শুদ্ধ মৃত্তিকার উঠানে মানবতাবাদ ও ন্যায় নৈতিকতার যে ফুল ফুটে। এই ফুল বাগানে অপরাধীদের ঠাঁই হতে পারেনা। এই অঙ্গিনার ফুল বাগান রক্ষার দায়িত্ব একা মালীর ওপর বর্তায় না। পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যের পূজারী, সাম্য শান্তি সম্প্রীতি পূজারী, ন্যায় নীতি নৈতিকতার পূজারীদের ওপরও বর্তায়। বিবেকের মনুষ্যত্ব দিয়ে, অমনুষ্যত্ব হিংস্র জানোয়ারদের নির্মূলে গর্জে ওঠার এখন সময়। মানবের বসত বাড়িতে দানবদের হানা রুখতে হবে। সকল অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে, বিবেকের মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করুন। বিবেক বিসর্জন দিয়ে হাত গুটিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখা কাপুরুষ মুনাফিকের লক্ষণ হয়কিনা?

মানুষরূপী হিংস্র অপরাধীরা আমাদের চারপাশে ঘুরা ফেরা করছে। আমাদের গা ঘেঁষে চলাফেরা করছে। আমরা তাঁদের চিনতে পারিনা। চিনতে পারিনা বলেই তাঁরা একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি অমাদের সমাজে মানুষের জানমাল ও মর্যাদার মূল্য কমিয়ে দিয়েছে। সমাজে যখন অপরাধীদের লাগাম থাকেনা। অপরাধীরা অপরাধ করে যখন আইনের আওতায় আসেনা। একের পর এক অপরাধ করে পার পেয়ে যায়। পুলিশের উপস্থিতিতে অপরাধীরা যখন প্রকাশ্যে অস্ত্রহাতে মহড়া দিয়ে, ফৌজদারি কার্যবিধির লঙ্গন করে। তখন বুঝতে হবে অপরাধীরা বেপরোয়া। সমাজ অশান্তির দিকে নৈরাজ্যের পথে হাটছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। বিয়ানীবাজারের আইন শৃঙ্খলা খারাপ না ভালো। মানুষই ভালো জানেন। কতোটা খারাপ হলে, চিনির ট্রাক হাইজ্যাক হতে পারে।

বিয়ানীবাজারের চারখাই থেকে ২৪ লাখ টাকার চিনি ছিনতাই এর ঘটনায় জড়িত এরা কারা? এরা এই মাটির গর্ভের নির্যাস থেকে জন্ম নিয়েছেন কিনা? সঙ্গত কারণে গত কয়েকদিন থেকে, দেশ বিদেশের অনেক মানুষের মুখোমুখে এই প্রশ্নটি উড়ে বেড়াচ্ছে। যে বা যারাই হোক না কেন, আমাদের ঐতিহ্যের অহংকারের বাগান কোন পশু ধ্বংস করে দিতে পারেনা। মানুষ হিসাবে, মনুষ্যত্ব জীবনধারণ যারা করেন, তারা অপরাধীদের কখনো সমর্থন করেননা।

রাজনীতির ছত্রছায়ায় আমাদের গায়ে গায়ে থেকে মিলেমিশে যাওয়া চিনি সিন্ডিকেট সাথে জড়িতদের অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে। এদের বাড়িঘর বংশ পরিচয়সহ তিন পুরুষের আদিঅন্ত জনসম্মুখে প্রকাশের এখন সময়। অসভ্য দুষ্কৃতিকারী ডাকাত দলের চুরি, ডাকাতি হাইজ্যাক রাহাজানি দস্যুতার কারণে, আজ গোটা সমাজ উদ্বিগ্ন। উৎকণ্ঠায় আছেন প্রবাসীরা। এদের অসৎ, অপরাধ তৎপরতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায়না। এরা সুযোগ পেলেই লুটে নিবে। শুধু শুধু পুলিশ প্রশাসনের দিকে চেয়ে থাকলে হবে না। সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এদের সকল অন্যায় আইন বিরোধী অপকর্ম রুখে দিতে হবে।

বিয়ানীবাজারের মত একটি ঐতিহ্যবাহী এলাকায় চিনি বুঝাই ট্রাক ছিনতাই এর ঘটনাকে উপজেলার মানুষ সহজে মেনে নিতে পারছেন না। চিনি ছিনতাইয়ের নির্দেশদাতা ও গডফাদার সিলেট জেলা ছাত্রলীগের যেই হোকনা কেনো? তাঁকে গ্রেফতারের দাবী জানাতে বিয়ানীবাজারের জনগণের আপত্তি নেই। এদের দৌরাত্মের টুঠি এখনই চেপে ধরতে হবে। নতুবা এই গডফাদারের নির্দেশে বিয়ানীবাজার উপজেলার মানুষের বাসা বাড়িতে দিনে দুপুরে, যখন তখন চুরি- ডাকাতি রাহাজানী ছিনতাই এর ঘটনা বৃদ্ধি পাবে কিনা । এতে করে উপজেলা সামগ্রীক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে কিনা? চিনি ডাকাত হাইজ্যাকার অসভ্যদের গডফাদার, মদদদাতা, পৃষ্ঠপোষক ছাত্রলীগের ক্ষমতাধর কতিপয় অসৎ অসভ্য নেতাদের সাহস হয় কি করে? বিয়ানীবাজার জনপদের ভিতরে তাদের অসৎ দুষ্কর্ম করার। তাদেরকে কে সাহস ও সুযোগ দিয়েছে। এরা বিয়ানীবাজারের স্থানীয় না বহিরাগত? নাকি টেঙ্গরি রাঢ় কুকিদের কোন উত্তরসূরী?

বিয়ানীবাজার উপজেলায়, আমার মতো অনেকের বাড়ি, অনেকের বাড়ির উঠান। আমার মতো আপনাদের বাড়ির আঙ্গিনায় জেলার চিনি ডাকাতরা রাষ্ট্রের আইন লঙ্ঘন করার যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। এতে আমাদের ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কিনা? উপজেলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হওয়ার পরও হাতেগোনা মানুষরূপী দস্যু দানব ডাকাতের কাছে পরাজিত হওয়ার গ্লানি রাখবেন কোথায়? প্রতিবেশী জেলা উপজেলার মানুষ কি বলতেছে কানপেতে শুনুন। সিলেটে বসে ছাত্রলীগ নামধারী যে সকল চিনি-ডাকাত হাইজ্যাকা তাদের দলীয় অনুগত্য বাহিনীর দ্বারা বিয়ানীবাজার এলাকায় ডাকাতি চুরি হাইজ্যাক ছিনতাই রাহাজানির রামরাজত্ব কায়েম করার দিবাস্বপ্ন দেখছেন। মানুষ হিসাবে, কোনো মানুষ বেঁচে থাকতে, ওই অসৎ স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবেনা। এটা শুদ্ধ মৃত্তিকার জনপদ বিয়ানীবাজার। এই মৃত্তিকার মাটি যেমন কোমল নরম। সময়ের প্রয়োজনে এই মাটি, কঠিন শিলায় রূপান্তরিত হয়ে আঘাত করতে জানে। রাজপথে জনতার আল্টিমেটাম সময়ের ব্যাপারমাত্র। জেলা- উপজেলার লুঠেরা ডাকাতদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসতে প্রশাসনের সময় ক্ষেপণ মানুষ বরদাস্ত করবেনা। জেলা ও থানা পুলিশের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন অজস্র মানুষ।

আমাদের বিয়ানীবাজার উপজেলার সকল মানুষের জান মাল ইজ্জত মর্যাদা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব শুধুমাত্র পুলিশ প্রশাসনের নয়। পুলিশের ওসি বা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এই অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নজরদারি করবেন। এর পাশাপাশি আইন প্রয়োগের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর হবেন। আইনশৃঙ্খলার অবনতি পুলিশের ব্যর্থতার বিষয়টি আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আইনশৃঙ্খলা কমিটি ও উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় কমিটির সভায় সংশ্লিষ্টদের কাছে কৈফিয়ত চাইবেন। জবাবদিহিতা করবেন। সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি কাছ থেকে মানুষ এমনটাই প্রত্যাশা করে। মানুষের ভাষায় মানুষের মনের কথা বলাই জনপ্রতিনিধির কাজ ও কর্তব্য। অপরাধীদের পক্ষে তাঁবেদারি করে সাফাই গাওয়া দায়িত্বশীলদের কাজ নয় মনে রাখতে হবে।

আমার মতো অনেকেরই প্রশ্ন হচ্ছে? উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানা পুলিশের ভাবপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আপনাদের বাড়ীর আঙ্গিনায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে গেলো। আপনাদের ভূমিকা মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয় কেন? আপনাদের পেশাদারিত্ব জবাবদিহিতার জায়গা দুর্বল হলে অসভ্য ডাকাত লুঠেরা দস্যুরা সুযোগ নিবে। আইনের রক্ষক হিসেবে পুলিশের কাজ নয় অপরাধীদের সাথে সমঝোতা করা। চিনি ডাকাতি কাণ্ডে দুই ছাত্রলীগ নেতার অডিও কথোপকথনে পুলিশের ভূমিকা ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লবের ভূমিকা তাঁদের ব্যক্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধে করেছে কিনা। তাঁরাই জানেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে থেকে বলতে হয়, নিজেদের নিয়ন্ত্রিত, পালাপোষা ডাকাতরা অনেক সময়, অনেক ওসি, এমপি, সরকারি কর্মকর্তা, চেয়ারম্যানদের বাসা বাড়িতে সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে। দুষ্কৃতিকারী দস্যু চিনি ডাকাত ও তাদের সহযোগীদের অবিলম্বে আইনের আওতায় নিয়ে আসা আপনাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কিনা? ডাকাত অপরাধী, সে যেই হোক, তার ক্ষমতার হাত যতই লম্বা হোক। সে মন্ত্রী-এমপি বা কোন বিশেষ ব্যক্তির লোক হোক। তাতে কি? সে তো রাষ্ট্র সমাজ ও আইনের চোখে অপরাধী। অপরাধী হিসেবে সমাজের কাছে পরিচিত। এই অপরাধীকে আইনের আনতেই হবে। বিয়ানীবাজারের মানুষ চায়, প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিজেদের অর্জিত অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব দিয়ে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন। উপজেলার মানুষের সামগ্রিক জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন।

লেখক : সাংবাদিক ও সমাজ অনুশীলক