বিয়ানীবাজারের পাতন-ফুল মলিকে
স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও হয়নি সেতু : ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ
স্বাধীনতার পরবর্তী সময় দেশব্যাপী উন্নয়নযজ্ঞের ফিরিস্তি দফায় দফায় প্রচারিত হলেও তার বাস্তবচিত্র অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন—বিশেষত সিলেটের প্রান্তিক অঞ্চলে। এর অন্যতম উদাহরণ সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার ১নং আলীনগর ইউনিয়নের ৫নং ও ৬নং ওয়ার্ডের মধ্যে কুশিয়ারা নদীর উত্তর পার হইতে সিলেট–জকিগঞ্জ–বিয়ানীবাজার আঞ্চলিক মহাসড়কের সাথে সংযুক্ত ফুলমলিক–পাতন–চন্দগ্রাম সড়কটি এলাকার প্রায় পাঁচ-ছয়টি গ্রামের একমাত্র যোগাযোগের পথ।
উক্ত সড়কের মাঝখানে করতি (বড় খালে) কোনো স্থায়ী সেতু না থাকায় এবং সড়কের বড় একটি অংশ কাঁচা থাকায় প্রায় ২২-২৩ হাজার মানুষ প্রতিদিন চরম দুর্ভোগে চলাচল করেন। এ সড়ক দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৩ কিলোমিটার হেঁটে আঞ্চলিক মহাসড়কে পৌঁছাতে হয়—তাও কাদা-পানি ও ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে।
বিশেষ করে রোগী, শিক্ষার্থী ও বৃদ্ধরা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করেন। হাটতে অক্ষম রোগীকে মাছ ধরার ফলো বা খাটে করে কাদা মাড়িয়ে ডাক্তার বা হাসপাতালে নিতে হয়। বর্ষাকালে অস্থায়ী বাঁশের সাঁকো ভেসে গেলে নৌকা দিয়ে পারাপার করতে হয়, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রাণহানির আশঙ্কাপূর্ণ। সন্ধ্যার পর নৌকা না থাকলে মানুষকে সাতরিয়ে খাল পার হতে হয়।
উপজেলার অন্যতম জনবহুল এই এলাকায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে চলাচলের চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। স্থানীয়দের দাবি—পাতন-ফুলমলিক খালের ওপর একটি স্থায়ী সেতু নির্মিত হলে এলাকার একাধিক গ্রামের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে, কৃষিপণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে আসবে গতি।
দীর্ঘদিনের দাবি, কিন্তু পদক্ষেপ নেই: স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বিয়ানীবাজার উপজেলার ১১ নং আলীনগর ইউনিয়নের ফুলমলিক প্রাচীন আমলের একমাত্র সড়কটি পাতন-ফুলমলিক খাল দ্বারা বিভক্ত। খালের ওপর সেতু না থাকায় গ্রামবাসী বছরের পর বছর বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছেন। প্রায় ৫০ মিটার দীর্ঘ খালের ওপর স্থানীয়রা নিজেদের উদ্যোগে বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করে চলাচলের ব্যবস্থা করেছেন। শুকনো মৌসুমে এ সাঁকো দিয়ে কোনোভাবে পারাপার করা গেলেও বর্ষায় তীব্র স্রোতে প্রায়ই তা ভেঙে পড়ে, ফলে বন্ধ হয়ে যায় চলাচল।
২০১৯ সালে স্থানীয়দের চাঁদায় দেড় লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাঁশের সাঁকোটি ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় ভেঙে যায়। এরপর গ্রামবাসী ছোট আকারে আরেকটি সাঁকো তৈরি করলেও ২০২৪ সালের বন্যায় সেটিও ধসে পড়ে। বর্তমানে অতি ঝুঁকিপূর্ণ একটি অস্থায়ী বাঁশের সাঁকো দিয়েই প্রতিদিন জীবন ঝুঁকি নিয়ে পারাপার করছেন স্থানীয়রা।
চিকিৎসা ও জরুরি সেবায় চরম দুর্ভোগ: গ্রামবাসীরা জানান, সেতুর অভাবে জরুরি প্রয়োজনে—বিশেষ করে অসুস্থ রোগী বা মরদেহ বহনের সময়—তীব্র ভোগান্তির শিকার হতে হয়। সম্প্রতি এলাকার এক যুবকের মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ বাড়িতে আনতে গিয়ে গ্রামবাসীকে মারাত্মক বিপাকে পড়তে হয়। বাধ্য হয়ে কয়েকজন মিলে কাঁধে করে মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসেন।
স্থানীয় যুবক আব্দুল করিমের ভাষায়, “সরকার পরিবর্তন হয়, কিন্তু আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। এমন জীর্ণ সেতু হয়তো আর কোথাও নেই।”
প্রস্তাব পাঠানো হলেও বাস্তবায়ন হয়নি: উপজেলা প্রকৌশল অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে এবং পরে ২০২২ সালেও পাতন-ফুলমলিক খালের ওপর একটি সেতু নির্মাণের জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। সর্বশেষ তিন বছর আগে অনূর্ধ্ব ১০০ মিটার সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ওই প্রস্তাব পাঠানো হয়। তবে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে চললেও সেতু নির্মাণের বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি।
উপজেলা প্রকৌশলী দীপক কুমার দাস বলেন,
“পাতন-ফুলমলিক খালের ওপর সেতু নির্মাণের জন্য আমরা প্রস্তাব পাঠিয়েছি। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু করা সম্ভব হবে।”
দায়িত্বশীলদের প্রতি গ্রামবাসীর আহ্বান:
প্রান্তিক এই জনপদের বাসিন্দারা জানান, দীর্ঘদিনের এই জনদুর্ভোগ লাঘবে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও জনপ্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন—পাতন-ফুলমলিক খালের ওপর একটি স্থায়ী সেতু নির্মাণ করে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে।










