কমিউনিটি ক্লিনিক: প্রান্তিক স্বাস্থ্যসেবার বিশ্বস্বীকৃত রোল মডেল
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবার মান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সিএইচসিপিদের সঙ্গে আলোচনা সভা
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে বসে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার এক নতুন ইতিহাস রচনা করছে কমিউনিটি ক্লিনিক (CC)। মাত্র দুই দশকের মধ্যে এই উদ্যোগ আজ শুধু দেশের নয়, বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রশংসিত। জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), ইউনিসেফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের এ মডেলকে উন্নয়নশীল দেশের জন্য এক অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
শুক্রবার (১ আগষ্ঠ) রাজধানীর বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগ থেকে প্রায় ২০০ জন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) অংশ নেন। অনুষ্ঠানে ১৫ জন প্রয়াত সিএইচসিপির পরিবারকে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো: আক্তারুজ্জামান এর নিজ উদ্যোগে এক লক্ষ টাকা করে বিশেষ অনুদান প্রদান করা হয়।
উপ সচিব নাসির উদ্দিন, প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা শামীম রেজা’র সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার। বিশেষ অতিথি হিসাবে আরো উপস্থিত ছিলেন ডা. আসিফ মাহমুদ; পরিচালক (মাঠ প্রশাসন), ডা. গীতা রানী দেবী; পরিচালক (প্রশিক্ষক), মো. ফেরদৌস ; বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি প্রমুখ। এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মো. আখতারুজ্জামান; ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট। প্রধান অতিথির বক্তব্যে জিয়া হায়দার বলেন- প্রান্তিক জনগণের কাছে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে আমার বিএনপি সরকার বিগত দিনে ইউনিয়নে ইউনিয়নে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এখন কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে এই সেবার বেইজমেন্ট তৈরি করতে হবে। তিনি আরো বলেন -আমাদের বিএনপি সরকারকে আপনারা সহযোগিতা করলে এই সেবাকে আরো জোরদার করা হবে। সভায় সভাপতির বক্তব্যে বলেন- এই সেবা একটি মহান পেশা।আপনারা আপনাদের দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করবেন এবং আপনাদের সকল দাবীগুলো পর্যায়ক্রমে আপনারা পেয়ে যাবেন।
কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত ৮ বিভাগ থেকে বক্তব্য রাখেন কমিউনিটি ক্লিনিক এসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি মোঃ জাহিদুল ইসলাম, (ঢাকা) সিনিয়র সহ সভাপতি রায়হান আলী, (রংপুর) সহ সভাপতি ফেরদৌস হোসেন,(রাজশাহী) সাধারণ সম্পাদক মোঃ নঈম উদ্দিন, (চট্রগ্রাম) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আকরাম চৌধুরী (সিলেট) মোঃ তরিকুজ্জামান (খুলনা) মাইন উদ্দিন রাহাত(ময়মনসিংহ)মাকছুদুর রহমান জিলাদার (বরিশাল) মল্লিকা আক্তার ও সালমা আক্তার।
উক্ত অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীবৃন্দ।
১৬৩ কোটি মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক : খান মোঃ রেজা-উন-নবী
প্রয়াতদের পরিবারের অশ্রুসজল নীরবতা এবং সহকর্মীদের আবেগঘন উপস্থিতি অনুষ্ঠানটিকে এক অনন্য মাত্রা দেয়। অনুদান গ্রহণ করতে এসে এক স্বজন বলেন— “আমাদের প্রিয়জন হয়তো আর নেই, কিন্তু তাঁদের কাজ দেশের হাজারো মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছে—এটাই আমাদের সান্ত্বনা।”
অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, “বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সিএইচসিপিরা অসামান্য ভূমিকা রাখছেন। তাঁদের আত্মত্যাগ ও নিবেদনের কারণেই কমিউনিটি ক্লিনিক আজ মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে।” তিনি বলেন ভবিষ্যত বাংলাদেশের স্বাস্থের নেতৃত্ব দেবে সিএইচসিপিরা এবং প্রতিটি সিসিতে ৩জন সিএইচসিপি নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
স্বাস্থ্য সেবার মূল স্তম্ভ: বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক সক্রিয় রয়েছে। এসব ক্লিনিক প্রতিদিন লাখো মানুষকে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য, টিকাদান, পরিবার পরিকল্পনা, পুষ্টি, সাধারণ রোগের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যপরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলের মানু ষের জন্য যেখানে চিকিৎসক বা হাসপাতালের নাগাল পাওয়া কষ্টসাধ্য, সেখানে এই ক্লিনিকগুলো হয়ে উঠেছে জীবনরক্ষাকারী আশ্রয়স্থল। বিশেষ করে দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য এটি এক অনন্য সেবা।
বিশ্বজুড়ে প্রশংসা: কমিউনিটি ক্লিনিককে এখন “বাংলাদেশ মডেল” বলা হচ্ছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার এ কার্যকর উপায়কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বারবার প্রশংসা করেছে। ইউনিসেফের মতে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় এটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য অনুসরণীয় উদ্যোগ।
জাতিসংঘের মহাসচিব একাধিকবার কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্যের কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের এই উদ্ভাবনী পদক্ষেপ আজ বৈশ্বিক স্বাস্থ্য অঙ্গনে গর্বের প্রতীক।
সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ: স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা আরও শক্তিশালী করতে হলে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তি, পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ এবং দক্ষ জনবল দিয়ে সমৃদ্ধ করা জরুরি।
সিএইচসিপিদের জীবনমান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও সময়ের দাবি। কারণ এঁরাই মাঠপর্যায়ে থেকে প্রান্তিক মানুষের জীবনে সরাসরি পরিবর্তন আনছেন।
শেষকথা: বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিক কেবল একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র নয়—এটি প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন। গ্রামীণ জনপদের অসহায় মানুষ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মহল—সবখানেই এ উদ্যোগ প্রশংসিত হচ্ছে।
আজ বিশ্ব জানে, স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশের এই উদ্ভাবন এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আর এর নেপথ্যে রয়েছেন নিভৃতপথের সিএইচসিপিরা, যাঁরা প্রতিদিন পরিশ্রম করে প্রমাণ করছেন—মানুষের পাশে দাঁড়ানোই সবচেয়ে বড় মানবতা।











