লোকসঙ্গীতের প্রাণপুরুষ ফকির আয়াজ বাঙ্গালী : সুরে অমর, জীবনে উপেক্ষিত
সিলেটের লোকগানের আকাশে উজ্জ্বল এক নাম—ফকির আয়াজ বাঙ্গালী। তাঁর গান আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে, গাঁ থেকে শহরে, ঘর থেকে মঞ্চে। অথচ এই সঙ্গীত সাধকের জীবন কাটছে অবহেলা, আর্থিক টানাপোড়েন ও দুঃখের ছায়ায়। সুরে, কথায় ও অনুভবে মানুষের হৃদয় জয় করা এই শিল্পীর সংসারে আজ অভাবই চিরসঙ্গী।
১৯৫৯ সালের ১০ জানুয়ারি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার কেছরীগুল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আয়াজ বাঙ্গালী। পিতা আশিদ আলী ও মাতা নেছা বেগমের ছায়ায় শৈশব কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মাঝেই। ছোটবেলায় অন্যের বাড়িতে গরু চরানো, ঈদের দিনও কাজের ছুটি না পাওয়া—এগুলি ছিল তাঁর জীবনের স্বাভাবিক অধ্যায়। কিন্তু সংগ্রাম থামাতে পারেনি তাঁর অন্তরের সঙ্গীতানুরাগ।
১৯৮৬ সালে শুরু হয় তাঁর গান লেখা ও গাওয়ার পথচলা আর ১৯৯৬ সালে তিনি পান সঙ্গীতগুরু মির মোহাম্মদ রামু সরকারের সান্নিধ্য। নিজেই লেখেন, সুর করেন ও কণ্ঠ দেন—তাঁর গানের প্রতিটি শব্দে মিশে থাকে দরদ, অনুভব ও জীবনের গল্প।
“আমার গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে—এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।”
—ফকির আয়াজ বাঙ্গালী
লোকজ ভাষা, গ্রামীণ যাপিত জীবন, শ্রমজীবী মানুষের হাসি-কান্নার গল্প তাঁর গানে ফুটে ওঠে সহজ, সাবলীল, তবু গভীর দর্শনে ভরা রূপে। এই মানুষটির লেখা গান গেয়ে আজ অনেক শিল্পী পেয়েছেন তারকা খ্যাতি। ইউটিউব ও টেলিভিশনের আলোয় তারা ঝলমল করলেও—আয়াজ বাঙ্গালী রয়ে গেছেন আড়ালে, অচেনা ও অবহেলিত।
১১ সদস্যের পরিবার নিয়ে আজও চলছে তাঁর কঠিন লড়াই। ভক্তদের ভালোবাসা আছে, কিন্তু সংসারের খরচ ভালোবাসায় চলে না। তবুও তিনি গাইছেন—কারণ তাঁর ভাষায়, “গলার সুরই আমার বাঁচার অবলম্বন।”
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা বেতার-টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পীর মর্যাদা—কোনোটাই এখনও তাঁর প্রাপ্য হয়নি। অথচ সিলেটি লোকগানের ইতিহাসে তাঁর অবদান অপরিসীম।
লোকসংস্কৃতি গবেষক মুখাল কান্তি দাস তাঁর চার শতাধিক গান সংগ্রহ করে সম্পাদনা করেন “চৌদ্দ নম্বর বেয়াক্কল” নামে গ্রন্থে। প্রকাশনায় সহায়তা করেন গীতিকার আবুল কাসেম ও মাছরাঙা প্রকাশন। এটি শুধু সাহিত্যকর্ম নয়—লোকশিল্পীকে ইতিহাসে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস।
উল্লেখযোগ্য কিছু গান:
- চৌদ্দ নম্বর বেয়াক্কল
- তাওয়ার মাঝে লাড়া দেছনা
- দেখিছ কিতা করে গো তাই
- শাকেরার মা দেউ না তুরা ঝুল
- ফাইতের ভিতরে টেম্পু যায়নি
- কন্যা সুন্দর ভাদেশ্বর
- ওগো মায়া লাগাউরি
- কানারে পথ দেখানি ভালা নায়
২০২১ সালে আশিকের কণ্ঠে তাঁর লেখা ও সুর করা ‘আসল আর নকল’ গানটি ইউটিউবে প্রকাশের পর মুহূর্তেই দেশ-বিদেশে ঝড় তোলে। শুধু একটি চ্যানেলেই গানটির ভিউ ছাড়ায় ২০ কোটিরও বেশি। সেই গান নতুন করে আলোচনায় তোলে ফকির আয়াজ বাঙ্গালীকে।
লোকগানের জীবন্ত ইতিহাস তিনি।
স্বীকৃতি নেই, সম্মান কম—তবু গান তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে, আর তিনি গানকে।
বাংলা লোকগান বেঁচে থাকবে, যতদিন ফকির আয়াজ বাঙ্গালীর মতো মানুষ সুরকে জীবন, আর জীবনকে সুর মনে করে বাঁচবেন।
সুরের মানুষ আয়াজ বাঙ্গালী—অমর হোক তাঁর গান, দীপ্ত থাকুক তাঁর নাম।











