হাকালুকি হাওর (Hakaluki Haor) সিলেট ও মৌলভীবাজারের ৫টি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মিঠা পানির জলাভূমি। হাকালুকি হাওর প্রায় ২৩৮ টি বিল ও ১০ টি নদীর সমন্বয়ে গঠিত এবং বর্ষাকালে এই হাওরের আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার হেক্টর। মাছের জন্য প্রসিদ্ধ হাকালুকি হাওরে শীতকালে অতিথি পাখিদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠে। এছাড়াও এখানে প্রায় ১০০ প্রজাতির স্থানীয় পাখি দেখা মিলে। হাওরের বিস্তির্ন ভূমি, বিল নির্ভর মানুষের জীবনযাত্রা এবং অথিতি পাখির আহ্বানে ভ্রমনপিয়াসীরা হাকালুকি হাওরে ছুটে আসে।
[embed]https://www.youtube.com/watch?v=zyxGVwDb-Mo&t=22s[/embed]
অতিথি পাখি দেখতে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস হচ্ছে হাকালুকি হাওর ভ্রমণের আদর্শ সময়। এ সময় হাওরের চারপাশ অতিথি পাখির কোলাহলে মুখর হয়ে থাকে। আর বর্ষাকালে হাওর সমুদ্রের রূপ ধারণ করে। তাই বর্ষাকালে হাওরের মজা নিতে চাইলে জুন-আগস্ট এই সময় আসতে হবে।
ঢাকা থেকে হাকালুকি হাওরে যেতে আপনাকে প্রথমে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া আসতে হবে। কুলাউড়া থেকে অটোরিক্সা বা রিক্সা ভাড়া করে সরাসরি হাওরে যাওয়া যায়। কুলাউড়া থেকে হাকালুকি হাওরে যেতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা অটোরিক্সা ভাড়া লাগে এবং রিকশা ভাড়া লাগে ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকার।
ঢাকা থেকে কুলাউড়া : ঢাকা থেকে সিলেটগামী যে কোন বাসে চলে আসতে পারেন কুলাউড়াতে। ঢাকার ফকিরাপুল, গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালি ও আবদুল্লাপুর বাস টার্মিনাল থেকে সিলেটের বাসগুলো ছেড়ে যায়৷ গ্রীন লাইন, সৌদিয়া, এস আলম, শ্যামলি ও এনা পরিবহনের এসি বাস যাতায়াত করে, এগুলোর কুলাউড়া পর্যন্ত ভাড়া সাধারণত ৭০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে। এছাড়াও ঢাকা থেকে সিলেট যেতে শ্যামলী, হানিফ, ইউনিক, এনা পরিবহনের নন এসি বাস জনপ্রতি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা ভাড়ায় পাবেন।
ঢাকা থেকে ট্রেনে করে কুলাউড়া যেতে কমলাপুর কিংবা বিমান বন্দর রেলওয়ে স্টেশান হতে উপবন, জয়ন্তিকা, পারাবত অথবা কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনকে বেছে নিতে পারেন আপনার ভ্রমণ সঙ্গী হিসাবে। শ্রেণী ভেদে জনপ্রতি ট্রেনে যেতে ভাড়া ২৮০ থেকে ৬৩৯ টাকা।
কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেল স্টেশান হতে রাতে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা উপবন এক্সপ্রেসে চড়ে সিলেটের ঠিক আগের ষ্টেশন মাইজগাও এ নামতে হবে। মাইজগাও থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার পথ হেটে ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার পর্যন্ত আসতে হবে। চাইলে অটোরিক্সা দিয়েও ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার আসতে পারবেন। ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে আল মুমিন রেষ্টুরেন্টে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে নৌকাঘাটে এসে দরদাম করে (প্রায় ১০ থেকে ১৫ জনের) দিনপ্রতি তিন থেকে চার হাজার টাকায় কুশিয়ারা নদী পাড় হয়ে হাকালুকি হাওড়ে ঘুরে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারেন।
হাওরে বিল ইজারাদারদের কুটিরগুলোতে বিল মালিকের অনুমতি নিয়ে ২ – ৪ জন অনায়াসেই রাত্রিযাপন করতে পারবেন। তবে বিল এলাকায় জোছনা রাতে তাঁবু ফেলে ক্যাম্পিং করার মুহুর্তগুলো আপনাকে আজীবন আনন্দ দেবে। এছাড়া পার্শবর্তী উপজেলা শহর বড়লেখায় রাত্রিযাপন করতে পারবেন। তবে রাত্রি থাকতে চাইলে নিজেদের নিরাপত্তার কথাও ভেবে নিতে হবে।
হাকালুকি হাওর ভ্রমণের সময় নৌকার মাঝির সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় বাজার করে নিলে মাঝিই আপনাদের রান্না করে খাওয়াবে। এছাড়া নৌকায় উঠার সময় বিস্কুট, চা, পাউরুটি, খাবার পানি ইত্যাদি হালকা খাবার নিয়ে ভ্রমণ করতে পারেন। যদি কোন হাওরের কর্মজীবী মানুষদের ম্যানেজ করতে পারেন তবে অল্প টাকায় তাদের সাথে ভাত আর মাছের ঝোল দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে পারবেন। হাওরে বেশ অল্পমূল্যে গরু মহিষের দুধ পাওয়া যায়।
ক্যাম্পিং করার জন্যে তাবু, রেইন কোট, বড় ব্যাকপ্যাক, শীতের সময়ে গেলে জ্যাকেট, কাদা-পানিতে চলন উপযোগী জুতা, গামছা, বাইনোকুলার, ক্যামেরা, প্রয়োজনীয় ব্যাটারি, পাওয়ার ব্যাংক, শুকনো খাবার, টর্চ এবং প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম।
হাকালুকি হাওর ক্রমাগত হয়ে পড়ছে সংকটাপন্ন:
এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি ক্রমাগত হয়ে পড়ছে সংকটাপন্ন। এখানে পরিবেশ বিনষ্টের মহোৎসব চলছে। প্রকাশ, বিলের জল সেচে মাছ আহরণ, অভয়াশ্রম বাতিল করে বিল ইজারা প্রদান, হিজল করচের জলাবন ধ্বংস, মাছ লুট ইত্যাদি কর্মকান্ড চললেও রহস্যজনক কারণে স্থানীয় প্রশাসন নীরব। পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কর্মকান্ডের ফলে হাকালুকি হাওরে মাছের উৎপাদন কমে গেছে। উল্লেখ্য, সরকার ১৯৯৮ সালে হাকালুকি হাওরকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) ঘোষণা করে। এরপর ইকোলজিক্যাল ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে হাওর উন্নয়নে কাজ শুরু করে। ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড পরিচালিত হওয়ার ফলে হাকালুকি হাওরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে। সেই সঙ্গে অতিথি পাখির সমাগম ঘটায় পরিবেশের ভারসাম্য ফিরে আসতে শুরু করে।
২০১০ সালে সরকার মাছের উৎপাদন বাড়াতে ১৮টি বিলকে মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। এতে মাছের উৎপাদন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু এর পরই ঘটে ছন্দপতন। অভিযোগ, এখানে লোলুপ দৃষ্টি পড়ে হাওরখেকোদের। এরই ধারাবাহিকায় ২০১৮ সালে হাওরখেকোরা মৎস্য অভয়াশ্রম বাতিল করতে নানামুখী তৎপরতা শুরু করে। অবশেষে ২০১৮ সালে ছয়টি বিল অভয়াশ্রম বাতিল করে রাজস্ব খাতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। পাশাপাশি বাড়তে থাকে পরিবেশবিনাসী কার্যকলাপ।
জানাগেছে, হাকালুকি হাওর দীর্ঘদিন ধরেই অরক্ষিত। নানা কারণেই হুমকির মুখে হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য এবং সরকার ঘোষিত মৎস্য অভয়াশ্রম। মৌলভীবাজার জেলার কুলউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা এবং সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলাজুড়ে হাকালুকি হাওরের অবস্থান। এর আয়তন প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর। ছোট-বড় ২৩৮টি বিল নিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকির আয়তন বর্ষা মৌসুমে ২৪ হাজার ৭০০ হেক্টর বিস্তৃত। হাওর তীরের কয়েক লাখ মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই হাওরের ওপর নির্ভরশীল। হাকালুকি হাওরকে মিঠাপানির মাছের অন্যতম প্রজননকেন্দ্রও বলা হয়।
অথচ এখন মাছের এমন আকাল যে, অর্ধেক মূল্যেও বিল ইজারা নিতে আগ্রহী হচ্ছে না মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিগুলো। তাদের মতে, ইজারার আগেই বিলের মাছ লুটে নেওয়া, অবৈধ মাছ শিকার বন্ধ না করা ও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় হাকালুকি হাওরের জলাশয়গুলোতে মাছের উৎপাদন কমে গেছে। বিভিন্ন বিলে সরকার নির্ধারিত ইজারা মূল্যের অর্ধেক দামেরও মাছ পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় ইজারা নিতে কেউ আগ্রহী হচ্ছেন না।
হাকালুকি হাওর আমাদের জাতীয় সম্পদ। এই হাওরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। বাংলাদেশে জলজ প্রজাতির অর্ধেকেরও বেশি হাকালুকি হাওরে জন্মে। এছাড়া হাওর এলাকায় ১১২ প্রজাতির পরিযায়ী এবং ৩০৫ প্রজাতির স্থানীয় পাখি বিচরণ করে। এখানে ১২ প্রজাতির উভচর, ৭০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৯ প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণী, ১২ প্রজাতির কচ্ছপ, ১০৭ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট, হাকালুকি হাওরের অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক গুরুত্ব অপরিসীম। এর পর্যটন গুরুত্বও নেহাত কম নয়। সংগত কারণেই এই হাওরের সুরক্ষায় সর্বোচ্চ যন্তশীল হওয়া জরুরি। এ বিষয়ে সরকার টেকসই পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসবে এটাই প্রত্যাশা।
হাকালুকি হাওর পর্যটন কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি আজ এখানে নেই আমি কাল আসব। স্থানীয় কৃষক আফতাব মিয়া বলেন, মাস দুইমাস পর পর তাহার দেখা পাওয়া যায়। তিনি আসেন এসেই আবার চলে যান। সুনেছি তিনি কুলাউড়ায় বাসা ভাড়া দিয়ে থাকেন। অতচ তাহার এখানে থাকার কথা। এ ব্যপারে প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।