শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাংলার মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য ভাষা শহীদদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকে স্মরণ করে জাতি 'অমর একুশে', ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে।
১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায়, বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২৩-এর প্রতিপাদ্য হলো বহুভাষিক শিক্ষা- একটি বহু ভাষিক বিশ্বে শিক্ষাকে রূপান্তরিত করার প্রয়োজনীয়তা।
ভাষা আন্দোলনের সেই বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে খালি পায়ে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” গাইতে গাইতে হাতে ফুল নিয়ে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানায়।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাস থেকে ১৪৪ ধারা ভেঙে তখনকার ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও কয়েকজন বীর সন্তান।
অমর একুশের চেতনা এখন বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অনুপ্রেরণার উৎস। তবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঠিক চর্চা ও সংরক্ষণে আমাদের আরও বেশি পরিশ্রমী হতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির আশীর্বাদে আমরা এখন একই বৈশ্বিক গ্রামের বাসিন্দা। তাই উন্নত বিশ্বের সঙ্গে অগ্রগতির ধারা বজায় রাখতে আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে বিভিন্ন ভাষায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে হবে, যা আন্তর্জাতিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন আমাদের নিজস্ব ভাষার উন্নয়ন ও সংরক্ষণের পাশাপাশি বহুভাষিক শিক্ষার মাধ্যমে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে- এটাই প্রত্যাশা।
অমর একুশের চেতনাকে ধারণ করে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হোক, বৈষম্যহীন বর্ণিল পৃথিবী গড়ে উঠুক- শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমার প্রত্যাশা। পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপা বিভাগের সম্মেলনে এমন কথা বলেন ডা.শাহনাজ আরেফন এনডিসি।
তিনি আরোও বলেন, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ অনুসরণ করে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর করব- স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট সোসাইটি গড়ে তুলতে সরকার অঙ্গীকারবব্ধ।
কমিশনার বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা পলাশী থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পুরো এলাকা সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারিতে নিয়ে এসেছি। পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে এলাকাটি পর্যবেক্ষণ করা হবে।
তিনি বলেন, কর্মসূচিকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং কূটনৈতিক কর্মকর্তারা প্রথমে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। তারপর, সাধারণ মানুষের জন্য এটি উন্মুক্ত করা হবে।
ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মানুষ পলাশী দিয়ে প্রবেশ করবে এবং দোয়েল চত্বর দিয়ে প্রস্থান করবে জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, কোনো ব্যাগ বা অন্যান্য জিনিসপত্র বহন করতে দেয়া হবে না।
দিবসটি উপলক্ষে জাতীয় দৈনিক পত্রিকা গুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে এবং বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বেসরকারি রেডিও স্টেশন ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দিবসটি উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে।
মহান ভাষা আন্দোলনের এত বছর পরও শহীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। প্রকাশিত তথ্য অনুসারে ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারি বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে বহু লোক নিহত হলেও তারা সবাই স্বীকৃতিও পাননি।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে প্রথম স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৩ সালের মার্চে। এর প্রকাশক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি মোহাম্মদ সুলতান। সম্পাদক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। সেই বইয়ে কবির উদ্দিন আহমেদ ‘একুশের ঘটনাপুঞ্জী’ নামে একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘শহীদদের লাশগুলো চক্রান্ত করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
মেডিকেল হোস্টেলের ভেতর ‘গায়েবি জানাজা’ পড়া হলো।...(পরদিন) সকাল নয়টায় জনসাধারণের এক বিরাট অংশ মর্নিং নিউজ অফিস জ্বালিয়ে দেয় এবং সংবাদ অফিসের দিকে যেতে থাকে। সংবাদ অফিসের সম্মুখে মিছিলের ওপর মিলিটারি বেপরোয়া গুলি চালায়। অনেকেই হতাহত হয় এখানে।’
১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পত্রিকা ‘সৈনিক’-এর প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে রাজধানী ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’। খবরে বলা হয়েছে, মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে নির্বিচারে পুলিশের গুলিবর্ষণ বৃহস্পতিবারেই ৭ জন নিহত: ৩ শতাধিক আহত।
তাছাড়া দৈনিক আজাদের ওই সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি গুলিতে ৯ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। বহু লাশ গুম করে ফেলা হয়েছিল।
ভারতের কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বৃহস্পতি ও শুক্রবার মোট ৯ জন নিহত’; আবার অন্য একটি সংবাদে ‘পুলিশের গুলিতে গতকল্য ও অদ্য এ যাবত ৬ জন নিহত হয়’ উল্লেখ করা হয়।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় সীমান্ত পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ কবিতা লেখেন। কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন ছিল এ রকম:
‘ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রোদ্রদগ্ধ
কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়...
চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত...’
উল্লেখিত কবিতায় কবি যে ৪০ সংখ্যাটি ব্যবহার করেছেন, তা কি শুধু কবিতার জন্য, নাকি এটি সত্য? আমরা মোটামুটি আটজন শহীদের নাম পেয়েছি।
পাকিস্তানের নির্বাসিত লেখক লাল খান তার পাকিস্তানস আদার স্টোরি: দ্য ১৯৬৮-৬৯ রেভল্যুশন বইয়ে লিখেছেন, পুলিশের গুলিতে ২৬ জন নিহত এবং ৪০০ জনের মতো আহত হয়েছিলেন। বইটি ২০০৮ সালে লাহোরে প্রকাশিত হয়।
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অলি আহাদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ২২ ফেব্রুয়ারি ভিক্টোরিয়া পার্কের (বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্ক) আশপাশে, নবাবপুর রোড ও বংশাল রোডে গুলিতে কতজন মারা গেছেন, তার সঠিক সংখ্যা কারও জানা নেই। আহমদ রফিক তার ‘একুশ থেকে একাত্তর’ নামের বইয়ে নিহতদের মধ্যে আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ ও সিরাজুদ্দিনের নাম উল্লেখ করেছেন।
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত কবির উদ্দিন আহমদ তার ‘একুশের ইতিহাস’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আটজনের মৃত্যুর কথা সন্দেহাতীতভাবে জানা যায়।’
এই সূত্র ধরে এম আর আখতার মুকুল আটজন ভাষাশহীদের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। তালিকাটিতে ২১ ফেব্রুয়ারি রফিকউদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম এবং ২২ ফেব্রুয়ারি শফিকুর রহমান, আব্দুল আউয়াল, অহিউল্লাহ ও অজ্ঞাত বালককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তবে ভাষাশহিদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন পাঁচজন—আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম ও শফিউর রহমান। ২০০০ সালে তাদের রাষ্ট্রীয় একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে। বরকত ও জব্বার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
রফিক ছিলেন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে। তারা তিনজন নিহত হন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মারা যান রিকশাচালক সালাম এবং হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান।
১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রাণ হারানোর তালিকায় আরো দুটি নাম পাওয়া যায়—অহিউল্লাহ ও আবদুল আউয়াল। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে ভাষাশহিদ হিসেবে এই দুজনের নাম-পরিচয় উল্লেখ আছে।
এ ছাড়া সালাউদ্দীন নামেও একজন ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ হন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু একুশের শহীদ হিসেবে তাদের স্বীকৃতি মেলেনি। আর এ কারণে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত পাঁচজনই ভাষাশহীদ হিসেবে সমাদৃত হচ্ছেন।
এবার দেখব সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার ডায়েরিতে কী লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ২১ ফেব্রুয়ারি, ‘গুলিতে চারজন ঘটনাস্থলেই নিহত হলো। আহত হলো ৩০ জন।’ জানা যায়, ৬২ জনকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। আরও শোনা যায়, পুলিশ কয়েকটি মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। বেসরকারি সূত্রের দাবি, মৃতের সংখ্যা ১০ থেকে ১১ জন।’ ২২ ফেব্রুয়ারি,
তিনি লিখেছেন, ‘আজ স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকল। হাইকোর্ট, মানসী সিনেমা হল ও ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের আশপাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেল। বেসরকারি সূত্র অনুয়ায়ী মৃতের সংখ্যা ১২, আহত বহু।’
আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ভাষা শহীদ আসলে কতো জন এই তথ্য চিরকাল অজানা থেকে যাবে যদি সরকার সংরক্ষিত তথ্যাদি প্রকাশ না করে। বর্তমান প্রজন্ম এই সংখ্যাটি জানতে আগ্রহী। কেননা ভাষা আন্দোলন থেকেই আমাদের জাতীয়তাবোধ জন্মে, আমরা স্বাধীনতার বীজ অন্তরে গাঁথি।
[embed]https://www.youtube.com/watch?v=NOjHP7OME54[/embed]