ফিলিস্তিনের গাজায় ত্রাণবাহী ৩৩টি ট্রাক ঢুকেছে। গতকাল রোববার পানি, খাদ্য ও ওষুধ নিয়ে এসব ট্রাক মিসর থেকে রাফা সীমান্ত দিয়ে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটিতে ঢোকে। রাফা সীমান্তের মুখপাত্র ওয়ায়েল আবো ওমর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত শুরুর পর এই প্রথম একসঙ্গে এত ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় ঢুকল। তবে ত্রাণকর্মীরা বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, চাহিদার তুলনায় এই ত্রাণ খুবই কম। হাজার হাজার মানুষ খাদ্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে জাতিসংঘের গুদামগুলোয় এসেছিলেন। কিন্তু প্রয়োজনমতো সেগুলো না পেয়ে তাঁরা ‘মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন’।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায় হামাস। এর জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় অনবরত হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। এতে গতকাল পর্যন্ত ৮ হাজার ৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ২০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন বলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়মিত ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে। এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে প্রায় এক হাজার মরদেহ পড়ে আছে। এ ছাড়া পশ্চিম তীরেও হামলা বাড়িয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। সেখানে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১২।
অন্যদিকে ইসরায়েলে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের হামলায় এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৩৩১ জন সেনা। এ ছাড়া নিজেদের বন্দীদের মুক্ত করে আনতে দুই শতাধিক ইসরায়েলিকে জিম্মি করে রেখেছেন হামাস যোদ্ধারা। জিম্মিদের বেশ কয়েকজন পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বৈত নাগরিক।
ত্রাণের জন্য মরিয়া
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান সত্ত্বেও গাজায় যথেষ্টসংখ্যক ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না ইসরায়েল। গতকাল ত্রাণবাহী মাত্র ১০টি ট্রাককে রাফাহ ক্রসিং হয়ে গাজায় ঢুকতে দেখা গেছে। এতে ওষুধ ও খাবার থাকলেও জ্বালানি ছিল না।
পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহ না থাকায় গাজায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। মানুষ খাবারের জন্য জাতিসংঘ পরিচালিত ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে মরিয়া হয়ে ছুটছেন। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা বাড়াতে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েনের চিন্তাভাবনা করছেন তাঁরা।
অবরুদ্ধ গাজার বাসিন্দারা ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল। সংঘাত শুরুর আগে সেখানে দিনে ৫০০ ট্রাক ত্রাণ সরবরাহ করা হতো। অথচ ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা শুরুর পর এ পর্যন্ত মাত্র ৯৪ ট্রাক ত্রাণ গাজায় ঢুকেছে। এ অবস্থায় ত্রাণ সরবরাহ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ।
এদিকে মানবিক বিপর্যয় চলার মধ্যে গাজার দ্বিতীয় বৃহত্তম আল-কুদস হাসপাতাল খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। সেখানে হামলা চালানোরও হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
গাজায় ইন্টারনেট ও টেলিফোন যোগাযোগ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। স্থল অভিযান শুরু করার আগে শুক্রবার রাতে গাজার টেলিযোগাযোগ দপ্তরে হামলা চালায় ইসরায়েল। এরপর বাকি বিশ্ব থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এ উপত্যকা।
গাজা থেকে সরবে না ইসরায়েল
ফিলিস্তিনের গাজায় স্থল অভিযানের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দিয়েছে ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা। গত শনিবার রাতে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর জনগণকে দীর্ঘ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘গাজা থেকে আমরা সরে আসব না।’
অবশ্য আগের দিন রাতেই গাজা উপত্যকায় বড় পরিসরে সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। শনিবার রাতে গাজায় আরও সেনা পাঠানো হয় বলে পরদিন জানান ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র দানিয়েল হাগারি।
গাজার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক লড়াই চলছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠন হামাস। তাদের সামরিক শাখা কাসাম ব্রিগেডস একটি ইসরায়েলি ট্যাংক ধ্বংসের ভিডিও প্রকাশ করেছে।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নেতানিয়াহু বলেছেন, গাজায় হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ ‘দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করেছে’। গাজা উপত্যকার ‘সর্বত্র’ সেনা ও কমান্ডার মোতায়েন করা হয়েছে।
জনগণকে দীর্ঘ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা হবে দীর্ঘ ও কঠিনতম যুদ্ধ। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জিতব; আমরাই ঠিকে থাকব।’
দৃশ্যত গাজার উত্তরাঞ্চল দখলের ইঙ্গিত দিয়ে নেতানিয়াহু আরও বলেন, ‘আমরা লড়াই করে যাব; আমরা আত্মসমর্পণ করব না। আমরা সরে আসব না। সেটা স্থলভাগের ওপর কিংবা ভূগর্ভে (টানেল) হোক।’ এই অভিযানকে তাঁর জীবনের মিশন বলেও উল্লেখ করেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী।
নেতানিয়াহু এমন সময় এ ঘোষণা দিয়েছেন, যখন উত্তর গাজার বাসিন্দাদের দক্ষিণে সরে যেতে ইসরায়েলি বাহিনী বিভিন্ন মাধ্যমে সতর্ক করে আসছে। এর আগে গাজার বাসিন্দাদের মিসরের সিনাইয়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে বলেছেন ইসরায়েলের কয়েকজন রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তা।
অপেক্ষায় আছি: হামাস
এদিকে গাজায় ইসরায়েলের স্থল অভিযান নিয়ে নেতানিয়াহুর ঘোষণার পর প্রতিরোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে হামাস। কাসাম ব্রিগেডসের মুখপাত্র আবু ওবায়দা বলেছেন, ‘আমরা এখনো তাঁর (নেতানিয়াহু) অপেক্ষায় আছি।’
হামাসের সামরিক শাখার মুখপাত্র আরও বলেন, ‘আল্লাহর সাহায্যে আমরা তাঁকে পরাজয়ের স্বাদ দেব, যে পরাজয় হবে, তাঁর ধারণা ও শঙ্কার চেয়ে বড়।’
একই সঙ্গে আরব বিশ্বের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন আবু ওবায়দা। তিনি বলেন, ‘আরব দেশগুলোর নেতাদের বলছি…আল্লাহ মাফ করুক, আমরা চাইছি না ইসলাম ও গাজার আরব শিশুদের রক্ষায় তোমাদের সেনাবাহিনী কিংবা ট্যাংক পাঠাও। কিন্তু তোমরা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছ যে, ত্রাণ ও মানবিক সহায়তাও পাঠাতে পারছ না।’
কাসাম ব্রিগেডসের মুখপাত্র বলেন, বন্দী বিনিময় ইস্যু নিয়ে অসংখ্যবার যোগাযোগ হয়েছে। একটি চুক্তির সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েল শর্তে রাজি না হওয়ায় তা ভেস্তে যায় বলে তিনি দাবি করেন।
ইসরায়েলি একটি ট্যাংক ধ্বংসের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে প্রকাশ করেছে কাসাম ব্রিগেডস। এ ছাড়া উত্তর গাজায় দুই ইসরায়েলি সেনা আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে তাঁরা। এক কর্মকর্তাসহ দুই সেনা আহত হওয়ার বিষয়টি ইসরায়েলি বাহিনীও নিশ্চিত করেছে।
নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক
এদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে আজ সোমবার আবারও বৈঠকে বসছে। জাতিসংঘের ব্রাজিলীয় স্থায়ী মিশন গত শনিবার এ ঘোষণা দিয়েছে। ব্রাজিল বর্তমানে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে।
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল পঞ্চবানী.কম এ লিখতে পারেন আপনিও। খবর, ফিচার, ভ্রমন, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি, খেলা-ধুলা। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন newsdeskpb@gmail.com ঠিকানায়।